ফুটপাত তুমি কার ?
- ফেরদৌসী পারভিন | Ferdawsi Pervin
- Jun 25, 2024
- 5 min read
পাঠক অদ্ভুত এই বাক্যটি শুনে আপনাদের খুব অবাক লাগছে তাইনা? অনেকেই হয়তো মনে মনে উচ্চারণ করে ফেলেছেন কার আবার পথচারীর । আসলেই তাই ফুটপাত পথচারীর জন্য । অর্থাৎ আমরা আমজনতা যারা পায়ের ওপর ভরসা করে হাঁটাহাঁটি করি অথবা পার্ক না থাকায় ফুটপাতকে ভরসা করে শরীর ঠিক রাখার জন্য বা ডায়েবিটিসের কারণে ফুটপাত দিয়ে হাঁটি তাদের জন্য ফুটপাত । ফুটপাত দিয়ে যেন আমজনতা নিশ্চিন্তে চলতে পারেন তার জন্য বড় রাস্তার পাশ দিয়ে ফুটপাত নির্মাণ করা হয় । রাস্তা নির্মিত হয় যানবাহন চলাচলের জন্য আর ফুটপাত , মানুষ চলাচলের জন্য । উন্নত দেশের মত আমাদের দেশেও ফুটপাতের দেখা মেলে তবে অক্ষত ফুটপাতের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ।
ঢাকা শহরের প্রায় সকল রাস্তায় কমবেশি ফুটপাত আছে । মিরপুর ,বনানী ,গুলশান বারিধারা ,বসুন্ধরা , উত্তরা ইত্যাদি এলাকায় ফুটপাত বহালতবিয়তে আছে । কিন্তু মূল রাস্তার পাশে কিঞ্চিৎ উঁচু যে রাস্তাটি তৈরি করা আছে এটা কার জন্য বানানো হয়েছে তা বুঝতে পারিনা । আমার মনে হয় যারা হেঁটে চলেন তারা কেউই বুঝতে পারেননা ।
আমি উত্তরায় বসবাস করি । খুববেশি দুরত্ব নাহলে হেঁটে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করি । আর তাই হাঁটতে হয় ফুটপাত দিয়ে । ঢাকার রাস্তায় চলাচল করা বিশাল একটা স্বাধীনতার ব্যাপার । রাস্তার দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন যে এখানে ট্রাফিক আইন বলে কোন জিনিস আছে তার তোয়াক্কা কেউ করেনা । যার যেমন ইচ্ছে নানানরকম যানবাহন নিয়ে ছুটে চলেছে । তিন চাকার রিকশা থেকে বি আর টিসির ডবল ডেকার পর্যন্ত নিজের ইচ্ছেমতো থামছে । সেটা রাস্তার মাঝখানেই হোকনা কেন? কারণ স্টপেজের বাইরে দাড়ানোর নিয়ম না থাকলেও আমরা আমাদের সুবিধামত নামি এবং উঠি । আর তাই যেকোন পরিবহন যেখানে সেখানে থামতে বাধা কোথায় ? তাহলেই বুঝুন রাস্তা যত প্রসস্থই হোকনা কেন যানজট খুব স্বাভাবিক ঘটনা । আমরা সবাই এর স্বাদ প্রতিদিন কমবেশি নিয়ে থাকি। সেখানে আপনি যদি চান কম দুরত্বে হেঁটে যাবেন । সময়ও বাঁচবে শরীরও ভালো থাকবে তাহলেই আপনি ভুল করবেন । । এবং আমি হলপ করে বলতে পারি আপনার মনে হবে হাঁটতে শুরু করে , আপনি ভুল করেছেন ।
ফুটপাত পথচারীর জন্য বানানো হলেও সেখানে কার দখল নাই । ধরুন আপনি হাঁটছেন । দুকদম না যেতেই দেখতে পাবেন চায়ের স্টলে বসে মানুষ চা খাচ্ছে । ফুটপাতের ওপরে বেস্ট বাইয়ের টুল বসিয়ে দেয়া হয়েছে । সেখানে বসে আরামে চা খাচ্ছেন হাত সিগারেট পাশে বন্ধু । তবে বান্ধবীও দেখেছি । কিছুটা এগুলেই দেখতে পাবেন কোন ফল নিয়ে বসে আছে বিক্রেতা । ফুটপাতের পাশের দোকানগুলি একেবারে ফুটপাত ঘেসে করেছে । তাদের বেশিরভাগ জিনিস ফুটপাতের ওপর সাজিয়ে রেখেছে । রড ,সিমেন্ট ,বালির বস্তা ফুটপাতে রেখে দিয়েছে । অথবা ট্রাক ফুটপাতে লাগিয়ে মালামাল তুলছে অথবা নামাচ্ছে । আপনি হেঁটে এসে আর যেতে পারছেন না । কিছু বল্লেই আপনার দিকে এমন করে তাকাবে যে , মনে হবে জীবনে এমন কথা কেউ বলেছে বা শুনেছে ! খালি প্লটে গ্যারেজ বানিয়েছে । গাড়ির কাজ ফুটপাতে হচ্ছে । যন্তাংশ খুলে ফুটপাতে রেখে দিয়েছে । বাইক পাইপ দিয়ে ওয়াশ করছে , কোথায় ফুটপাতে । শ্রমিক শ্রেণির মানুষ কাজের ফাঁকে ফুটপাতে বসে লুডু খেলছে । আপনার পা ফেলার জায়গা না থাকলেও তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । অনেকসময় এরা জটলা বেঁধে আড্ডা দেয় । চলাচলের পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় এদের গায়ে ধাক্কা লাগছে । ঢাকার রাস্তায় হাঁটছেন আর মানুষের ধাক্কা খাবেননা এটা অসম্ভব ব্যাপার । কোন কোন রাস্তায় ভাড়ার মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে । সেখান দিয়ে পাস করতে গেলে কোন রসালো মন্তব্য হবে আপনার জন্য উপরি পাওনা ।
রাস্তার পাশের যদি হাসপাতাল থাকে তাহলে ফুটপাতে এম্বুল্যান্সের সারি দেখা যাবে । আর ফুটপাত জুড়ে থাকবে ফল ,চা নাস্তার দোকান । পান সিগারেটও পাওয়া যায় ফুটপাতে । সন্ধ্যের মুখ থেকে বসে যায় গার্মেন্টসের রিজেক্ট পোশাকের পশরা । সিজনাল ফল সবজিতো আছেই । ফুটপাতেই আপনি আপনার ওজন মেপে নিতে পারবেন । ডায়েবিটিস মাপার ব্যবস্থাও আছে । অনেক ফুটপাতে কিছু সময়ের জন্য বাজারও বসে যায় । মাছ তরকারি থেকে শুরু করে গ্রোসারির সবকিছু পাওয়া যায় ।
জ্যাম লাগলে বাইক চালান যারা তারা ফুটপাতে বাইক নিয়ে উঠে পড়তে কালবিলম্ব করেননা । আশেপাশের বাসাবাড়ি থেকে আর্বজনা ফেলে যায় ফুটপাতে । ফুলের গাছ বা ছবির হাট বসে যায় ফুটপাতে ।
একদিন আমি নিজের কিছু কাজ সারার জন্য বের হলাম। হেঁটে যাব এবং ফিরবো সেটাই করি আমি । কিন্তু কিছুদূর যেতেই মেজাজ বিগড়ে গেল । এই অল্প সময়ে একজনের সাথে ধাক্কা খেয়েছি । দুপা না যেতেই কিছু না কিছু ফুটপাতে যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে । আরো কিছুটা সামনে যেয়ে দেখি এক পুলিশের সদস্য দাঁড়িয়ে আছে । তাকে বললাম , আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন আপনার সামনে সমস্তটা দখল করে এরা ব্যবসা করছে। আমরা হাঁটবো কি করে? তিনি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন । তারপর বললেন আপনি থানায় যেয়ে অভিযোগ করেন ম্যাডাম । তাহলেই বোঝেন কত সহজ সমাধান । আমি জানি থানায় গেলে বলবে এটা সিটি করপোরেশনের অধীনে তাই তাদের জানান । আমি ক্ষান্ত দিয়ে নিজের কাজে চলে গেলাম ।
এতো গেল দোকানপাটের কথা । আমাদের ফুটপাত কখনো অক্ষত দেখেছেন কেউ । আমার মনে হয় নাহ । কদিন পর পর দেখি এগুলো ভাঙা হয় তারপর নতুন রুপে গড়া হয় । তারপরেই দেখা যায় কয়েকদিনেই এর ভাঙাচোরা চেহারা । আর উঁচু নিচুতো আছেই । ফুটপাতের ঢেউয়ে পা মচকানো লোক খুঁজলেই খুব সহজে আপনি পেয়ে যাবেন । দূর্মুখেরা বলে অনেক কথা । আবার যারা সেখানে বসে ব্যবসা করছে তারাও বলে । তাদের কাছে জানতে চাইলেই বলে যে , তারা ,
যারা ফুটপাতে বসে আয় রোজগার করে ,প্রতিদিন চাঁদা দেয় । যার বিনিময়ে তারা বসতে পারে । এই চাঁদা তোলার জন্য লোক আছে এবং এলাকা ভাগ করা আছে। এমনকি যেসব ভিক্ষুক বসে ভিক্ষা করে তাদের বসার স্থানের বিনিময়ে চাঁদা দিতে হয় । তাদের এলাকাও ভাগ করা । আর এসব নিয়ন্ত্রণ করে কথিত বড় ভাইরা । আমি অবশ্য জানিনা তারা কারা ! আমি বা আমরা জানতেও চাইনা এর কতটুকু সত্যি বা কতটুকু মিথ্যা । শুধু চাই ফুটপাত আমার চলাকে নির্বিঘ্ন করুক ।
দুচারটে দেশে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে । সেসব দেশের দুপাশ জুড়ে একাধিক ফুটপাত । মানুষ সেখানে হাঁটে । বাজার বসায়না । দোকানপাট তুলে দখল করেনা ।
আমরা যারা চলতি পথে কেনাকাটা সারি তাদের কিছুটা সুবিধা হয় বলেই চুপ করে থাকি । কিন্তু আমার বা আপনার সামান্য সুবিধার জন্য শৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটানো যাবেনা ।
ফুটপাতের যতরকম দোকানপাট আছে তা তুলে দিয়ে নাগরিকের যাতায়াতের পথ নির্বিঘ্ন করা দরকার । যে কথাগুলো বলার চেষ্টা করলাম সেটা শুধু উত্তরার সমস্যা নয় ঢাকার সব এলাকার ফুটপাতের সমস্যা কমবেশি । ফুটপাত দখল মুক্ত হয়ে পথচারীর হোক । আজকের শিশু যেন বুঝতে পারে ফুটপাত পায়ে চলার পথ । রোড ,সিমেন্ট বা খাট পালং রাখার জায়গা নয় । দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা মাফিক পন্য ক্রয় বিক্রয় করার জন্য নির্দিষ্ট বাজার আছে । তাছাড়াও নামি দামী ডিপার্টমেন্ট স্টোর আছে যেখানে সবকিছু পাওয়া যায় । সেখানে নিজেদের পছন্দমত সুবিধাজনক স্থানে যেতে পারি । এবং সেটাই হওয়া উচিত ।
আমরা প্রত্যকেই বেঁচে থাকার জন্য সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যার যার মত করে ঘরে বাইরে পরিশ্রম করি। যাদের প্রতিদিন বাইরে যেতে হয় জীবন জীবিকার উদ্দ্যেশ্যে , তারা জানেন রাস্তার বিড়ম্বনা কতটা । দখল হওয়া ফুটপাত আর যানজটে নাকাল নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে পারে শৃঙ্খলা পূর্ণ যাতায়াত ব্যবস্থা । কতৃপক্ষের সাথে সাথে আমরা যারা নাকাল হচ্ছি তাদেরও সঠিক কাজটি করতে হবে। নিয়ম ,আইন থাকবে এবং আছে কিন্তু তার বাস্তবায়ন দরকার । আজকের শিশুটি যে আগামীর নাগরিক তার চলাচলকে নির্বিঘ্ন করতে হবে । সে যেন বুঝতে পারে তার জন্ম হয়েছে একটি সুন্দর ও স্বাধীন দেশে । তাকে যেন বিদেশের নিয়ম শৃঙ্খলা বাঁধতে নাপারে তাদের মাটিতে । পথচারীর ফুটপাত পথচারীকে ফিরিয়ে দিতে হবে । দেখতে চাই কিশোরী মেয়েটি যেন বেনী দুলিয়ে স্বছন্দে স্কুলে হেঁটে যেতে পারে । তাকে যেন ফুটপাত দখলকারীদের অসংগত কথার শিকার হতে না হয় ।
প্রফেসর ফেরদৌসী পারভিন
সাবেক অধ্যক্ষ গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজ
Comments